কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা


কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

Posted By:
Mostafa Kamal
Researcher of DCPL & BDTP / Ph.D (Study)
Affiliated Ph.D Researcher of IOUT & Academic Associate of
Shikshakendra, Hati More, Subash Pally, Siliguri, W.B. INDIA
Chairman of Dynamic Youth Society, Public Library & Study Center.
Address: Samsabad, P.S.- Panchbibi, Dist. Joypurhat, N.B. BANGLADESH.
Contact : +88-01911 450 131; E-mail:aboutdynamic@gmail.com

প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে জীবনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা এখন যুগের দাবি। শিক্ষাজীবনের শুরুতে প্রাথমিক স্তর থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের তত্ত্বীয় শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক তথা হাতে-কলমে শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। শিশুদের জন্য এমন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে, যা তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে স্বনির্ভর হতে সহায়তা করে। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সেই শিক্ষা যেন কাজে লাগে। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের যা শেখানো হচ্ছে তা এক ধরনের গৎবাঁধা তাত্ত্বিক শিক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। শিশু শিক্ষার্থীদের কাছে স্কুল আনন্দদায়ক মনে হয় না। শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় প্রাণের স্পন্দন জাগে না। শিক্ষা আনন্দময়। আনন্দঘন পরিবেশে শিশুদের পাঠদান সুনিশ্চিত করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠ্যক্রম বহুলাংশে শহর ও গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠী আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ও জীবনমুখী নয়। দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, শিষ্টাচার, নৈতিকতা, জীবনধর্মী বিষয়াদিসমৃদ্ধ ন্যূনতম পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও চর্চা একান্ত জরুরি।

আমাদের সন্তানদের জন্য কী ধরনের শিক্ষা দরকার? এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, জীবন যেমন হওয়া উচিত, শিক্ষাও তেমন হওয়া উচিত। জীবন ও শিক্ষা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তাই জীবনের চাহিদা মেটাতে সক্ষম সে রকম শিক্ষা চাই। আলবার্ট আইনস্টাইন বলতেন, জ্ঞানের চেয়ে বড় হচ্ছে কল্পনাশক্তি। আইনস্টাইন খুব বড় মাপের বিজ্ঞানী ছিলেন, সত্যি কথা বলতে কী তিনি কত বড় বিজ্ঞানী সেটা বোঝার মতো বিজ্ঞানীও পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। সেই আইনস্টাইন জ্ঞান থেকেও কল্পনাশক্তিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন তার নিশ্চয়ই একটি কারণ আছে। কারণটি সহজ, জ্ঞান অর্জন করা যায় কিন্তু কল্পনাশক্তি অর্জন করা যায় না। মানুষ কল্পনাশক্তি নিয়ে জন্মায়, সেই অমূল্য শক্তিকে খুব যত্ন করে লালন করতে হয়, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে মহান কাজগুলো হয়েছে এই কল্পনাশক্তির কল্যাণে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে কল্পনাশক্তির দরকার, যাদের কল্পনাশক্তি নেই তাদের এই পৃথিবীকে দেওয়ার কিছুই নেই। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সেই কল্পনাশক্তি এবং সৃজনশীলতাকে পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়।
অধুনা শিক্ষাকে দুটো পর্যায়ে ফেলা হয়েছে : সাধারণ শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা। বৃত্তি হলো জীবিকা, কর্ম বা পেশা। বৃত্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাই বৃত্তিমূলক শিক্ষা। যে শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থী হাতে-কলমে শিক্ষা লাভ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে তাকে বলা হয় বৃত্তিমূলক শিক্ষা। বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যক্তিকে কোনো না কোনো পেশার উপযোগী করে তোলে। সাধারণ পর্যায়ের বৃত্তিমূলক শিক্ষা বলতে বোঝায় কোনো বিষয়ের স্বল্পমেয়াদি ব্যবহারিক শিক্ষা। যেমন : কৃষিকাজ, দর্জির কাজ, রাজমিস্ত্রির কাজ, কাঠমিস্ত্রির কাজ, রঙের কাজ, সাইকেল, রিকশা ইত্যাদি মেরামতের কাজ, রেডিও, টেলিভিশন, ফ্রিজ ইত্যাদি বৈদ্যুতিক গৃহসামগ্রী মেরামতের কাজ, হাউস ওয়ারিং, বাস-ট্রাক ইত্যাদির চালকের কাজ, সাধারণ বা প্রাথমিক চিকিৎসার কাজ, কাপড় ইস্ত্রি, আধুনিক পদ্ধতিতে হাঁস-মুরগি পালন, গরু, ছাগল ও ভেড়ার খামার করা, মৎস্য চাষ, সেলুনের কাজ ইত্যাদি। এ ধরনের শিক্ষা অল্প সময়ে স্বল্প ব্যয়ে সহজেই গ্রহণ করা যায়। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে মানুষ কৃষিতে, শিল্পে সর্বত্র বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার করছে। তাই এসব ক্ষেত্রে কাজ করতে গেলে বৃত্তিমূলক শিক্ষা অত্যাবশ্যক।
বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য দরকার বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত লাখ লাখ কর্মঠ, উদ্যোগী যুবক। কৃষিতে, কুটিরশিল্পে, বৃহৎশিল্পে সর্বত্র উৎপাদন ও সেবার মান বৃদ্ধি এবং উন্নয়নের জন্য চাই বৃত্তিমূলক শিক্ষা। আজকের পৃথিবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশগুলো এবং এশিয়ার চীন, জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া উন্নতি লাভ করেছে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমেই। উন্নত বিশ্বের জনসাধারণের মধ্যে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রচলন ও গুরুত্ব অনেক বেশি। তারা সার্টিফিকেটে বিশ্বাসী নয়, কাজে বিশ্বাসী। তারা কোনো কাজকে খাটো করে দেখে না। তাই সেসব দেশে বৃত্তিমূলক শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
উন্নত দেশে শিক্ষা মানেই কাজ, চাকরি। তারা জীবন ও প্রয়োজন উপযোগী শিক্ষা লাভ করছে। তাদের পেশাভিত্তিক কারিগরি শিক্ষাই কাজের দিশা দেয়। প্রয়োগভিত্তিক শিক্ষা লাভের অভাবে আমাদের ছাত্ররা নিজের বা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। হাইটেক বা অতি উন্নত প্রযুক্তির যুগে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী ও জুতসই প্রযুক্তির শিক্ষা দিতে হবে। সিঙ্গাপুরের স্কুলগুলোতে প্রথম শ্রেণি থেকেই কম্পিউটারভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। সাধারণ শিক্ষার দিন এখন শেষ হয়ে গেছে। বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করে জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তর থেকেই কৃষিশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের নিবিড় কৃষিশিক্ষার লক্ষ্যে স্বতন্ত্র পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং কৃষিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করা প্রয়োজন। ব্যবহারিক কৃষিশিক্ষার জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কৃষি প্রদর্শনী প্লট বা বাগান গড়ে তোলা বাধ্যতামূলক আইন জারি করতে হবে। বিদ্যালয় বাগান হবে কৃষিশিক্ষার জীবন্ত বিদ্যাপীঠ। এখানে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে কৃষিভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ পাবে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা প্রকৃতি পাঠ, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং প্রায়োগিক কৃষিশিক্ষার ওপর বাস্তব ধারণা লাভ করবে। বিদ্যালয়ের সৌন্দর্যবর্ধন ও উন্নয়নের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম স্বনির্ভরতা অর্জনে সক্ষম হবে।
জাতীয় অগ্রগতি, টেকসই উন্নয়ন এবং জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে বর্তমানে প্রচলিত পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষার স্থলে আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি সুদৃঢ় করার জন্য ন্যূনতম আট বছর মেয়াদি শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা অত্যাবশ্যক। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে আট হতে বারো বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষার মেয়াদ চালু রয়েছে। অষ্টম শ্রেণি শিক্ষা শেষে পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন।
মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রাথমিক শিক্ষাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। জীবনধর্মী ও কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করা সম্ভব। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য হলো শিশুর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক, মানবিক ও নান্দনিক বিকাশ সাধন এবং তাকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করা। এ বিশাল লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। পুঁথিগত মুখস্থ বিদ্যার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে হাতে-কলমে দক্ষতা অর্জনের ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে। দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে শিক্ষাই একমাত্র মাধ্যম। আমাদের ন্যায় দরিদ্র ও অনুন্নত দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি জীবনমুখী শিক্ষার মধ্যেই নিহিত রয়েছে।