উচ্চ শিক্ষার সিঁড়ি


উচ্চ শিক্ষার সিঁড়িআপনি কোথায় পা বাড়াবেন ?

মোস্তফা কামাল
একটা জাতি কতটা উন্নত তার মানদন্ড হলো আসলে ঐ জাতি কতটা শিক্ষিত।বর্তমান সময়ে অধিক জনসংখ্যা যেখানে বোঝা বনে যায় কোন অনগ্রসর জাতির জন্য সেখানটায় আমাদের উচিত এই সমস্যা নিয়ে ভাবা।আসলে কিভাবে আমরা আমাদের নির্দিষ্ট জনসংখ্যাকে কাম্যজনসংখ্যার স্তরে নিয়ে যেতে পারি।
এই ভাবনার উদ্রেক হয় মূলত যখন কোন শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার পথে পা রাখে।এই শিক্ষা সম্পন্ন করে তাকে পাড়ি দিতে হবে বন্ধুর এক পথ।যেখানে প্রতিনিয়ত থাকবে কোন না কোন চ্যালেঞ্জ।এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার শক্তি আর সামর্থ্য দুটো থাকা চাই নয়তো যুদ্ধ শুরুর আগে আপনি এক পা পিছিয়ে গেলেন।মূলত আমাদের সিস্টেমের প্রেক্ষাপটে এই চিন্তাকে দুঃশ্চিন্তার বিষয় বানিয়ে ফেলে বাবা মা ও গার্ডিয়ানরা। এমন পরিস্থিতিতে আমরা দাঁড়িয়ে চিন্তা না করাটাই যেন অস্বাভাবিক বটে।
আমরা যদি এই বিষয়ে একটু সোচ্চার হই তবে অদূর ভবিষ্যতে অনেক দুঃশ্চিন্তা হতে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারব। কিভাবে ?
আলোচনায় আসা যাক । আমাদের শিক্ষার যে পদক্রম তা অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার পথচলা মূলত শুরু হয় যখন কোন শিক্ষার্থী নবম-দশম শ্রেনীতে উঠে। যেমন কোন শিক্ষার্থী যদি বিজ্ঞান বিভাগে বা বাণিজ্য বিভাগে নয়তো মানবিকে ভর্তি হয় তখন থেকে তার একটা গতিপথ তৈরি হয়ে যায় না বরং আমরা তৈরি করে দিই।
বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা মূলত ডাক্তার নয়তো ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন লালন করে,ব্যবসায় শিক্ষার একজন শিক্ষার্থী চার্টাড একাউন্টেট নয়তো প্রথিতযশা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ-এমবিএ করার স্বপ্ন দেখে।মানবিকের শিক্ষার্থীদের গন্ডি এখানে ছোট থাকে তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে স্নাতক স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কোন সাবজেক্ট।একজন শিক্ষার্থী যে কিনা এত কিছু বোঝার আগে আমরা তার জন্য অনেকাংশে বরাদ্দ করে দিই তাকে কি করতে হবে। এটা কোন নিয়ম হতে পারে না। আমাদের শিক্ষার যে প্রচলিত ধারা সে অনুযায়ী উচ্চ মাধ্যমিকের পর্বটা শিক্ষার্থীদের জন্য একটা রোলার মেশিন ছাড়া আর কিছু না।এখানে বিশাল একটা সিলেবাসের সাথে খুব কম সময় বরাদ্দ থাকে।এই বিষয়টাতে সবাই একমত হবেন।
তাছাড়া এখন নতুন এক পদ্ধতি যেখানে রীতিমতো হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সবাই এগিয়ে থাকার জন্য সেটা জিপিএ র ভিত্তিতে মেধা যাচাইয়ের পদ্ধতি। আমার মতে এটা অনেকটা অযৌক্তিক বটে। ঘটনাক্রমে যদি আমার দুটো বোর্ড পরীক্ষায় জিপিএ ৫ না আসে তবে কি আমি মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার যোগ্যতা হারিয়ে বসব। এখন সবখানে আপনার যোগ্যতা আপনার নামের পাশে জিপিএ কত ? এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন!  অদূর ভবিষ্যতে বিয়ে-শাদীর মামলাতে জিপিএ র মতো টার্ম চলে আসবে এটা ভেবে নিতে পারেন। এইতো গেল মেধাবীদের নিয়ে আমাদের সিস্টেম আর আমাদের কর্মকান্ডের কথা।
সম্প্রতি এইচ.এস.সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে সকল পরীক্ষার্থীরা একরাশ স্বপ্ন নিয়ে নেমে পড়েছে প্রস্তুতির মহারণে। দেশে বিদ্যমান শিক্ষার্থীদের তুলনায় পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যোগান না থাকায় আরো একটা সংকট তৈরি হয়ে আছে।
এই প্রশ্নটা সবার জন্য শিক্ষার্থী বা গার্ডিয়ান সবার জন্য ………
আপনি তো উচ্চশিক্ষার সিঁড়িতে বসে আছেন,সামনে কোথায় পা বাড়াবেন ?যেখানটায় আপনার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।
প্রথমে আসি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রসঙ্গে….
যারা কিনা বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ালেখা করে তাদের জন্য এই স্টেজে এসে দুটো মোক্ষম পথ বেছে নিতে বলে যেমনঃ
১.মেডিকেল
২.ইঞ্জিনিয়ারিং
আপনি যদি সেবার মানসিকতা নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করতে পারবেন বলে নিজে মনে করেন,পাশাপাশি আপনি চ্যালেঞ্জ নিতে সমর্থ হলে আপনি এই দুটো পেশার যেকোন একটাতে যেতে পারেন।এখানে মেধার চেয়ে সহ্য শক্তিটাও জরুরী। এই দুই লোভনীয় পেশার বাইরে দেশের পাবলিক বা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আপনি চাইলে পদার্থ,রসায়ন,গণিত,জীববিজ্ঞান ও পরিসংখ্যানের পাশাপাশি বর্তমানের সময়োপযোগী যেকোন সাবজেক্টে ভর্তি হতে পারেন।এই যেমন ফার্মাসী,মাইক্রোবায়োলজী,ফলিত রসায়ন,ফলিত পদার্থবিদ্যা,কম্পিউটার প্রকৌশলবিদ্যা,মেরিন সায়েন্স এন্ড ফিশারীজ,ফরেস্ট্রী এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স,সয়েল সায়েন্স ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং সহ আরো নানান প্রকার স্পেসিফিক ডিপ্লোমা কোর্স।
বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য আসন বরাদ্দ রয়েছে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের সকল সমন্বিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে,তাছাড়া ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাশাপাশি পলিটেকনিক, নার্সিং ও প্যাথলজির উপর ডিপ্লোমা কোর্স করেও ক্যারিয়ার সাজানোর সুযোগ রয়েছে।
এখন আপনি  পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও মূল বিষয়গুলোর উপর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেন।
এবার আসি ব্যবসায় শিক্ষা শাখার কথায়…..
দেশের অবকাঠামোগত ও নানান অসুবিধার কারণে সিংহভাগ শিক্ষার্থী এই বিভাগে পড়ালেখা করতে ইচ্ছুক। এখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকুরীর চটকদার বিজ্ঞাপনগুলো যেখানে একজন বিবিএ বা এমবিএ ধারীকেই প্রাধান্য দেয়।বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা বা প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষার যথাযথ উপায় উপকরণ সরবরাহের অপ্রতুলতার জন্য শিক্ষার্থীরা বিমুখ হয়ে পড়ে বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি। এটা নিছক কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা বলা যায়।
দেশের শতকরা ৫০ ভাগের অধিক শিক্ষার্থী যারা উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে বিশাল সংখ্যায় আসে ব্যবসায় শিক্ষার হয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে।এরা সংখ্যায় বিশাল হলেও তাদের জন্য আসন বরাবরই অপ্রতুল।দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্দিষ্ট সংখ্যক আসনের পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে বেশ কিছু সংখ্যক আসন,তবে এই সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান আর ভবিষ্যত ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিমুখী হয় শিক্ষার্থীরা।
এখানে একজন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে একাউন্টিং,ফিন্যান্স,মার্কেটিং,ম্যানেজমেন্ট,ব্যাংকিং ও এইচ.আর.এম,ট্যুরিজম এন্ড হোটেল ম্যানেজমেন্ট এই বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ালেখা করার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি কেবলই মূলধারার বিষয়গুলো পাবেন।তাছাড়া একজন ব্যবসায় শাখার শিক্ষার্থী হয়ে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌথভাবে মানবিকের সাথে আনুপাতিক হারে সমন্বিত কিছু অনুষদে ভর্তি হতে পারে।এই যেমন আপনি সাহিত্য নিয়ে পড়তে চান তবে বাংলা,ইংরেজী,ফারসী,সংস্কৃত ও আরবি বিষয়ে পড়তে পারবেন।
এইসব বিষয়ের বাইরে সমন্বিত গ্রুপে আপনি অর্থনীতি,লোকপ্রশাসন,আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক,গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা,সমাজতত্ব,রাজনীতি বিজ্ঞান,নৃ-বিজ্ঞান,ইতিহাস,দর্শন,ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে পড়ালেখা করতে পারেন।
দেশে একাডেমিক শিক্ষার বাইরে গিয়ে চারুকলা, নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিষয়ে পড়তে পারেন উচ্চ শিক্ষা যদি আপনার এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটি বা যোগ্যতা থাকে।তাছাড়া আপনি যদি চান স্বকীয় কিছু করে ক্যারিয়ার গড়তে তবে আইন বিষয়ে পড়ে একটা ভিন্ন প্লাটফর্মে ক্যারিয়ার গড়েত পারবেন। পাবলিক ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সাবজেক্টের প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
উপরোক্ত বিষয়গুলোতে প্রায়ই তিন শাখার শিক্ষার্থীদের জন্য সিট বরাদ্দ করে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের এই সময়ে এসে উচ্চ শিক্ষার সুবিধা ভোগ করার সুযোগ রয়েছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে আইবিএর মতো আর্ন্তজাতিক মানের অনুষদ। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন সাবজেক্টকে বিশেষায়িত করা হয়েছে যেমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন, রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং (আইইআর/বি৭) নামে আলাদা বিভাগ খোলা হয়েছে। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত ক্রিমিনোলজী ও ফিল্ম এন্ড মিডিয়া রিলেটেড অনুষদও রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগরে রয়েছে  ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি নামে অনুষদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ফিজিক্যাল এডুকেশন এন্ড স্পোর্টস সায়েন্স নামে আলাদা অনুষদ।
এখন আপনি বা আপনারা চিন্তা করুন কোন অনুষদে আপনার জন্য যথার্থ সুবিধা রয়েছে।আপনি যদি কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়ালেখা করতে চান বা ক্যারিয়ার গড়তে চান তবে এখনই নেমে পড়ুন এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করুন।
ইতিমধ্যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে বাকিগুলো খুব শীঘ্রই করবে।আপনি চিন্তা করুন আপনার জন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কোন অনুষদ যথাযথ তা বুঝে ছক কষা শুরু করেন।আপনাদের অনেকেই একটা পরিকল্পনার মধ্যে আছেন। এখন নিজেকে আরো একবার গুছিয়ে নিন আর ভবিষ্যতের জন্য এগিয়ে রাখতে নিজেকে আরো একবার প্রস্তুত করে নিন।
এই স্বল্প সময়ে আপনার কোন পরিশ্রম যাতে বৃথা না যায় তার নিশ্চয়তা কেবল আপনিই দিতে পারেন। ভর্তি সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে আছে ,আমরা এখন যথেষ্ট আপডেট অতটা পিছিয়ে থাকার নই।
ভর্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষার্থীদের বাবা-মা এবং গার্ডিয়ানের উদ্দেশ্য  বলতে চাই……….
আপনার সন্তান যদি স্বেচ্ছায় কিছু করতে চাই অবশ্য তাকে সেটা করতে দিন কেননা কোন শিক্ষার্থী যদি ডাক্তারী পেশাকে নিজের জন্য উপযুক্ত মনে না করে তার উপর যদি চাপিয়ে দিয়ে তাকে ডাক্তার বানাতে চাই।এক্ষেত্রে হিতে বিপরীতও হবে আমরা একটা অযোগ্য ডাক্তার যেমন পাব তেমনি সম্ভাবনাময় কোন এক প্রতিভাকে হারাব।
আপনার সুচিন্তিত একটা মতামত গড়ে দিতে পারে ভবিষ্যতের সুন্দর একটা ক্যারিয়ারের ভিত্তি।
এটা কেবল ডাক্তারীকে উদ্দেশ্য করে বলা না,এটা মূলত সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ।যার মাথায় সাহিত্যের নানান কলকাঠি খেলা করে তার মাথায় তো আইনের প্যাঁচ বা অর্থনীতির সমস্যা কিংবা ম্যাথের সূত্র বোধগম্য হবে না।
সকল ভর্তি পরীক্ষার্থীদের জন্য শুভকামনা রইল। আগামীতে সুন্দর একটা প্রজন্ম আমরা পাব সেই আশাবাদ রাখি।আমাদের শিক্ষায় যে অচলাবস্থা চলছে তা কাটিয়ে উঠতে পারব এবং মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব বিশ্ব দরবারে।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো আমাদের দেশের নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়ালেখা শেষ করে মেধা পাচারের ফাঁদে পড়ছে বিশেষ করে যারা বুয়েট বা মেডিকেল হতে পড়ালেখা সম্পন্ন করে। কর্তৃপক্ষের এই বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো দরকার এবং যুগোপযোগী হস্তক্ষেপ কাম্য