নতুন পদ্ধতি শিক্ষার প্রতি শিশুর আগ্রহ বাড়াবে
Posted By:
Mostafa Kamal
Researcher of DCPL
& BDTP / Ph.D (Study)
Affiliated Ph.D
Researcher of IOUT & Academic Associate of
Shikshakendra, Hati
More, Subash Pally, Siliguri, W.B. INDIA
Chairman of Dynamic
Youth Society, Public Library & Study Center.
Address: Samsabad,
P.S.- Panchbibi, Dist. Joypurhat, N.B. BANGLADESH.
Contact : +88-01911
450 131; E-mail:aboutdynamic@gmail.com
শিক্ষা
মানুষের জন্মগত অধিকার। তবে এ সর্বজনীন অধিকারটি যেন বর্তমান বিশ্বে ক্রমান্বয়ে
পণ্য হয়ে উঠেছে। কেবল বিত্তবানরাই তাদের সন্তানদের ভালো শিক্ষা দিতে পারছেন।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেক সন্তান স্কুলে দু-চার ক্লাস পড়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে
ঝরে পড়ছে। কাকে কীভাবে কী শিক্ষা দিতে হবে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সে বিষয়ে
পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কথা বলা যায়। এ দেশের শিশুশিক্ষা
অভিন্ন মানসিকতাসম্পন্ন দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি করতে পারছে না। কারণ, এ দেশে চলছে
বিভিন্ন রকম শিক্ষাব্যবস্থা। একেক রকম শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুরা একেক রকম সংস্কৃতি ও
মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে বেড়ে উঠছে। যেমন, এ দেশে রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি মালিকানার
নানারকম স্কুল। সেনাবাহিনী পরিচালিত স্কুল, চার্চ পরিচালিত স্কুল, এনজিও পরিচালিত
স্কুল। আবার রয়েছে ধর্মপ্রভাবিত বিভিন্ন রকম মাদ্রাসা। আলিয়া, কওমি, ফোরকানিয়া,
হাফিজিয়া, মহিলা, ক্যাডেট মাদ্রাসা ইত্যাদি। বাংলা ও আরবি ভাষা প্রভাবিত
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও ক্রমেই
বাড়ছে। এসবের মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল কারিকুলাম পড়ানো ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল,
যুক্তরাজ্যের এডেক্সেল ও ক্যামব্রিজ কারিকুলাম পড়ানো ইংরেজি মাধ্যম স্কুল এবং
বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশন পরিচালিত ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। ফলে তিন রকম ভাষায় (বাংলা,
ইংরেজি, আরবি) ভিন্ন ধরনের কারিকুলাম পড়ে এ দেশের শিশুরা বেড়ে উঠছে। এরা বড় হয়ে
কীভাবে একইরকম মনোভাবাপন্ন দেশপ্রেমিক নাগরিক হবে?
শিশুরা কী পড়তে চায়, তারা কী জানতে চায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশি অভিভাবকদের মনোযোগ নেই। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের সব সময় পরীক্ষায় ফার্স্ট দেখতে চান। সে জন্য প্রয়োজনে সন্তানের আনন্দ নস্যাৎ করতেও তারা দ্বিধা করেন না। এ জন্য সাধ্যমতো টাকা খরচে তাদের কার্পণ্য নেই। কিন্তু শিশুরা লেখাপড়ায় আনন্দ পাচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে তারা একটুও মনোযোগী নন। উল্টো তারা তাদের সন্তানদের কোচিংয়ের পর কোচিং করান; তাদের জন্য টিউটরের পর টিউটর রাখেন। অল্পবয়সে শিশুর কাঁধে এত বেশি বই-খাতার ভার চাপিয়ে দেয়া হয় যে শিশু শিক্ষার্থী তার স্কুলব্যাগ বইতে পারে না। মা বা অন্য কাউকে শিশুর বইতে হয় স্কুলব্যাগ। এর ফলে মারা যায় শিশুর আনন্দ। শিশুকে জিজ্ঞেস করা হয় না সে কী করতে চায়। কী পড়তে তার ভালো লাগে। শিশু অঙ্ক পছন্দ না করলেও তাকে অঙ্কের ক্লাস করতে হয়। শিশু যদি বলে অঙ্ক ভালো লাগছে না, আমি এ ক্লাসে বসব না, তাহলে সর্বনাশ, তার স্কুলে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ বাংলাদেশি শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুর ভালো লাগা বা না লাগার মূল্য নেই। এখানে পাঠ্যক্রমের জেলখানায় বন্দি করে শিশুর আনন্দ হত্যা করে তার ওপর চালানো হয় এক ধরনের নির্যাতন। অভিভাবকরা নীরব। তাদের এসব ভাবার সময় নেই। শিশুর আনন্দ মারা গেলে তাদের কিছু এসে যায় না। তাদের বিসিএস অফিসার চাই। ডাক্তার চাই। পাইলট চাই। ইঞ্জিনিয়ার চাই। এ উদ্দেশ্যে লেখাপড়ার চাপ সৃষ্টি করে কেড়ে নেয়া হয় শিশুর আনন্দ। যে স্কুল শিক্ষার্থীকে যত চাপে রাখে, সে স্কুলের ওপর অভিভাবকরা তত বেশি খুশি হন।
একটু পরিকল্পনা করে কি শিশুশিক্ষাকে আনন্দময় করা যায় না? মাথার ওপর পরীক্ষার বোঝা না চাপিয়ে খেলাধুলা, নাচ-গান ও বিভিন্ন রকম সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কি শিশুদের গড়ে তোলা যায় না? ফার্স্ট-সেকেন্ড অথবা নম্বর বা গ্রেডের প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে এনে নিজ নিজ আগ্রহের বিষয়ে কি তাদের সৃষ্টিশীল কাজে উদ্বুদ্ধ করা যায় না? এমনটি করাতে পারলে একই সঙ্গে শিশুর লেখাপড়া ও বেড়ে ওঠা আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। এসব বিষয়ে কি আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্টদের কোনো মনোযোগ আছে? কেবল ঢাকার কতিপয় কূটনৈতিক মিশন পরিচালিত ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বাদ দিলে মূলধারার স্কুলগুলোতে সে ব্যবস্থা নেই। মূলধারার শিশুশিক্ষায় কেবল লেখাপড়ার চাপ আর চাপ। সেখানে শিশুর মানসিকতার বিকাশ ও আনন্দের সুব্যবস্থা নেই।
পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে নিচের ক্লাসগুলোয় শিশুদের ওপর লেখাপড়ার চাপ দেয়া হয় না। তাদের ক্লাসরুমের বাইরে খোলা মাঠে অনেক কিছু করানো হয়। পুঁথিগত বিদ্যার চাপ কমিয়ে নাচ-গান, হাসি-আনন্দ, ছবি আঁকা ও খেলাধুলার মধ্য দিয়ে অনেক কিছু শেখাতে শেখাতে তাদের মানসিক বিকাশের সুব্যবস্থা করা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় কেউ সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হতে চাইলে তাকে মাস্টার অব টিচিং ডিগ্রি করতে হয়। সে ক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই শিশু মনস্তত্ত্ব পড়ে আসতে হয়। শিশুর মনের ভাবনা ও জগৎটিকে না বুঝলে শিক্ষক কীভাবে শিশুকে পড়াবেন? কীভাবে বুঝবেন শিক্ষার্থী শিক্ষায় আনন্দ পাচ্ছে কিনা? ভুলে গেলে চলবে না, হোমওয়ার্কের চাপ আর বকাঝকার ওপর রাখলে শিশুর কাছে শিক্ষা উপভোগ্য হয় না।
শিশুদের লেখাপড়া নিয়ে পাশ্চাত্যে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে এবং হচ্ছে। সম্প্রতি আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) মিডিয়া ল্যাব এমন একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। সম্মানিত পাঠকদের এখানে শিশুশিক্ষার এই নয়া উদ্যোগ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করব। উল্লেখ্য, এমআইটি হল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিশ্বের এক নম্বর ইউনিভার্সিটি। এ বিশ্ববিদ্যালয়টির মিডিয়া ল্যাব খুবই আধুনিক ও উন্নত। আমি নিজে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় মিডিয়া ল্যাব সম্পর্কে ভাবতাম, এখানে হয়তো গণমাধ্যম ও কম্পিউটার সম্পর্কিত আধুনিক লেখাপড়া হয়। কিন্তু গত ২০ আগস্ট এমআইটি ভিজিট করাকালীন সরেজমিন মিডিয়া ল্যাবের কার্যক্রম দেখে আমার ধারণা একেবারেই পাল্টে গেছে। দুটি বড় অত্যাধুনিক বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন ফ্লোরজুড়ে অবস্থিত মিডিয়া ল্যাবে ত্রিশটি রিসার্চ গ্রুপ গবেষণারত রয়েছে। কী নেই মিডিয়া ল্যাবের গবেষণায়? রয়েছে আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স থেকে উন্নত ক্যামেরা তৈরি, কৃত্রিম অঙ্গ তৈরির (বাইয়োমেকাট্রনিক্স) গবেষণা থেকে সোশ্যাল কম্পিউটিং। এই ল্যাবের সোশ্যাল মেশিন গ্রুপের পিএইচডি ছাত্র ও ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা নাজমুস সাকিবের কাছ থেকে বিস্তারিতভাবে জানলাম শিশুশিক্ষাকে আনন্দদায়ক ও ফলোদায়ক করার ক্ষেত্রে তাদের উল্লিখিত নতুন এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কে। সনাতনি মন্টেসরি স্কুলের (এ রকম স্কুলে শ্রেণীকক্ষ থাকে না এবং শিক্ষার্থীকে স্বাধীনতা দেয়া হয়) ধারণার সঙ্গে সেন্সর প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে তারা এই নয়া শিশুশিক্ষা ব্যবস্থার উদ্ভাবন করেছেন।
মিডিয়া ল্যাবের সোশ্যাল মেশিন রিসার্চ গ্রুপ বস্টনের নন-প্রফিট সংগঠন ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফাউন্ডেশনের সহায়তায় শিশুশিক্ষায় ‘সেনসেই’ প্রজেক্টের অধীনে সফলভাবে এ এক্সপেরিমেন্ট করে যাচ্ছে। জাপানি ভাষায় ‘সেনসেই’ শব্দের অর্থ হল শিক্ষক। কিন্তু তারা এর পূর্ণ নাম দিয়েছেন ‘সেন্সিং এডুকেশনাল ইন্টারেকশন’। এ শিশুশিক্ষা পদ্ধতিতে মনটেসরি স্কুলের মতো শ্রেণীকক্ষের ধারণা ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখানে সেন্সর প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে শিশুদের আগ্রহের এলাকা ও বিষয়বস্তু জানা হয়। আর একবার কোনো শিশুর আগ্রহ ও আনন্দের জায়গাটি চিহ্নিত করতে পারলে তাকে ওই বিষয়ে কাজ করিয়ে এগিয়ে নেয়ার কাজটি সহজ হয়ে যায়। শিশুর একাডেমিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষক-পর্যবেক্ষণ ও সামাজিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন- একটি শিশু যদি অঙ্ক না করতে চায়, তার ওপর অঙ্ক করার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয় না। সুকৌশলে অঙ্কে আগ্রহী অন্য সহপাঠীর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব করিয়ে দেয়া হয়। এ ব্যবস্থায় নিজের আনন্দ ও আগ্রহের জায়গায় কাজ করে শিশুরা তাদের স্কুলের সময় ও লেখাপড়া উপভোগ করতে পারে।
এ শিক্ষা পদ্ধতিতে কীভাবে শিশুর আগ্রহ জানা হয়- জানতে চাইলে নাজমুস সাকিব বলেন, আমাদের শিশুশিক্ষা পদ্ধতিতে ক্লাসরুম কনসেপ্ট নেই। একটি বড় ঘরে কতিপয় শিক্ষক শিশুদের শিক্ষা দেন। তাদের শিক্ষাদানকারী ভূমিকার চেয়ে শিশুদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের ভূমিকাই বেশি। এ পদ্ধতিতে শিশু স্কুলে এলে তার জুতা পরিবর্তন করে তাকে বিশেষভাবে তৈরি করা ছোট্ট মাইক্রোচিপযুক্ত সেন্সর লাগানো জুতা পরিয়ে শিক্ষাকক্ষে ছেড়ে দেয়া হয়। এ রকম সেন্সর শিক্ষাকক্ষের অন্যত্র এবং শিক্ষা উপকরণের ট্রেতেও ব্যবহার করা হয়। শিক্ষাকক্ষে শিশু সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাকে কোনো বিশেষ সময় বিশেষ বিষয়ে পড়তে বা শিখতে বলা হয় না। শিশু নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোনো শিক্ষক বা সহপাঠীর কাছে তার ইচ্ছামতো সময় কাটাতে পারে। সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকরা পরে কোন শিশুর কোন বিষয়ে কতটা আগ্রহ তা বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে তার অবস্থানের সময় নির্ণয় করে বুঝতে পারেন। ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ম্যাসাচুসেটসের বোস্টন শহরের ৬টি স্কুলে পরীক্ষামূলকভাবে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে শিশু শিক্ষাদান কার্যক্রম সফলভাবে চলমান রয়েছে।
এ নতুন শিশুশিক্ষা ব্যবস্থায় কেমন সাড়া পাচ্ছেন- এ প্রশ্নের উত্তরে সাকিব বলেন, প্রযুক্তিনির্ভর এ পদ্ধতিতে শিক্ষা দিতে গিয়ে শিক্ষকরা বেশ এক্সাইটেড। এতে করে শিক্ষকরাও অনেক কিছু শিখতে পারছেন। কেন কোনো শিশু তার কাছে বেশি সময় না দিয়ে অন্য একজন শিক্ষকের কাছে অধিক সময় দিচ্ছে, তা নিয়ে তারাও ভাবিত হচ্ছেন এবং এতে তাদের শিক্ষাদান পদ্ধতি উন্নত করতে নতুনভাবে চিন্তা করার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে এ পদ্ধতিতে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা কিছুটা ব্যয়বহুল। কিন্তু পদ্ধতিটি ফলোদায়ক হওয়ায় ইতিমধ্যে অভিভাবক এবং শিক্ষা গবেষকদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে। এ কারণে সেনসেই প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফাউন্ডেশনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। প্রযুক্তিনির্ভর এ নতুন শিক্ষাব্যবস্থা পাশ্চাত্য সমাজের জন্যও একটি নতুন শিশুশিক্ষা পদ্ধতি। তবে যেহেতু পদ্ধতিটি ইতিমধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ফলোদায়ক প্রমাণিত হয়েছে, সে কারণে আশা করা যায়, আগামী দিনের শিশুশিক্ষায় এ নতুন শিক্ষা পদ্ধতিটি ব্যয়বহুল হলেও একটি সমাদৃত শিশুশিক্ষা পদ্ধতি হিসেবে প্রথমে পাশ্চাত্যে এবং পরে ক্রমান্বয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রসারিত হবে।
শিশুরা কী পড়তে চায়, তারা কী জানতে চায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশি অভিভাবকদের মনোযোগ নেই। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের সব সময় পরীক্ষায় ফার্স্ট দেখতে চান। সে জন্য প্রয়োজনে সন্তানের আনন্দ নস্যাৎ করতেও তারা দ্বিধা করেন না। এ জন্য সাধ্যমতো টাকা খরচে তাদের কার্পণ্য নেই। কিন্তু শিশুরা লেখাপড়ায় আনন্দ পাচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে তারা একটুও মনোযোগী নন। উল্টো তারা তাদের সন্তানদের কোচিংয়ের পর কোচিং করান; তাদের জন্য টিউটরের পর টিউটর রাখেন। অল্পবয়সে শিশুর কাঁধে এত বেশি বই-খাতার ভার চাপিয়ে দেয়া হয় যে শিশু শিক্ষার্থী তার স্কুলব্যাগ বইতে পারে না। মা বা অন্য কাউকে শিশুর বইতে হয় স্কুলব্যাগ। এর ফলে মারা যায় শিশুর আনন্দ। শিশুকে জিজ্ঞেস করা হয় না সে কী করতে চায়। কী পড়তে তার ভালো লাগে। শিশু অঙ্ক পছন্দ না করলেও তাকে অঙ্কের ক্লাস করতে হয়। শিশু যদি বলে অঙ্ক ভালো লাগছে না, আমি এ ক্লাসে বসব না, তাহলে সর্বনাশ, তার স্কুলে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ বাংলাদেশি শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুর ভালো লাগা বা না লাগার মূল্য নেই। এখানে পাঠ্যক্রমের জেলখানায় বন্দি করে শিশুর আনন্দ হত্যা করে তার ওপর চালানো হয় এক ধরনের নির্যাতন। অভিভাবকরা নীরব। তাদের এসব ভাবার সময় নেই। শিশুর আনন্দ মারা গেলে তাদের কিছু এসে যায় না। তাদের বিসিএস অফিসার চাই। ডাক্তার চাই। পাইলট চাই। ইঞ্জিনিয়ার চাই। এ উদ্দেশ্যে লেখাপড়ার চাপ সৃষ্টি করে কেড়ে নেয়া হয় শিশুর আনন্দ। যে স্কুল শিক্ষার্থীকে যত চাপে রাখে, সে স্কুলের ওপর অভিভাবকরা তত বেশি খুশি হন।
একটু পরিকল্পনা করে কি শিশুশিক্ষাকে আনন্দময় করা যায় না? মাথার ওপর পরীক্ষার বোঝা না চাপিয়ে খেলাধুলা, নাচ-গান ও বিভিন্ন রকম সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কি শিশুদের গড়ে তোলা যায় না? ফার্স্ট-সেকেন্ড অথবা নম্বর বা গ্রেডের প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে এনে নিজ নিজ আগ্রহের বিষয়ে কি তাদের সৃষ্টিশীল কাজে উদ্বুদ্ধ করা যায় না? এমনটি করাতে পারলে একই সঙ্গে শিশুর লেখাপড়া ও বেড়ে ওঠা আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। এসব বিষয়ে কি আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্টদের কোনো মনোযোগ আছে? কেবল ঢাকার কতিপয় কূটনৈতিক মিশন পরিচালিত ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বাদ দিলে মূলধারার স্কুলগুলোতে সে ব্যবস্থা নেই। মূলধারার শিশুশিক্ষায় কেবল লেখাপড়ার চাপ আর চাপ। সেখানে শিশুর মানসিকতার বিকাশ ও আনন্দের সুব্যবস্থা নেই।
পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে নিচের ক্লাসগুলোয় শিশুদের ওপর লেখাপড়ার চাপ দেয়া হয় না। তাদের ক্লাসরুমের বাইরে খোলা মাঠে অনেক কিছু করানো হয়। পুঁথিগত বিদ্যার চাপ কমিয়ে নাচ-গান, হাসি-আনন্দ, ছবি আঁকা ও খেলাধুলার মধ্য দিয়ে অনেক কিছু শেখাতে শেখাতে তাদের মানসিক বিকাশের সুব্যবস্থা করা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় কেউ সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হতে চাইলে তাকে মাস্টার অব টিচিং ডিগ্রি করতে হয়। সে ক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই শিশু মনস্তত্ত্ব পড়ে আসতে হয়। শিশুর মনের ভাবনা ও জগৎটিকে না বুঝলে শিক্ষক কীভাবে শিশুকে পড়াবেন? কীভাবে বুঝবেন শিক্ষার্থী শিক্ষায় আনন্দ পাচ্ছে কিনা? ভুলে গেলে চলবে না, হোমওয়ার্কের চাপ আর বকাঝকার ওপর রাখলে শিশুর কাছে শিক্ষা উপভোগ্য হয় না।
শিশুদের লেখাপড়া নিয়ে পাশ্চাত্যে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে এবং হচ্ছে। সম্প্রতি আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) মিডিয়া ল্যাব এমন একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। সম্মানিত পাঠকদের এখানে শিশুশিক্ষার এই নয়া উদ্যোগ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করব। উল্লেখ্য, এমআইটি হল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিশ্বের এক নম্বর ইউনিভার্সিটি। এ বিশ্ববিদ্যালয়টির মিডিয়া ল্যাব খুবই আধুনিক ও উন্নত। আমি নিজে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় মিডিয়া ল্যাব সম্পর্কে ভাবতাম, এখানে হয়তো গণমাধ্যম ও কম্পিউটার সম্পর্কিত আধুনিক লেখাপড়া হয়। কিন্তু গত ২০ আগস্ট এমআইটি ভিজিট করাকালীন সরেজমিন মিডিয়া ল্যাবের কার্যক্রম দেখে আমার ধারণা একেবারেই পাল্টে গেছে। দুটি বড় অত্যাধুনিক বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন ফ্লোরজুড়ে অবস্থিত মিডিয়া ল্যাবে ত্রিশটি রিসার্চ গ্রুপ গবেষণারত রয়েছে। কী নেই মিডিয়া ল্যাবের গবেষণায়? রয়েছে আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স থেকে উন্নত ক্যামেরা তৈরি, কৃত্রিম অঙ্গ তৈরির (বাইয়োমেকাট্রনিক্স) গবেষণা থেকে সোশ্যাল কম্পিউটিং। এই ল্যাবের সোশ্যাল মেশিন গ্রুপের পিএইচডি ছাত্র ও ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা নাজমুস সাকিবের কাছ থেকে বিস্তারিতভাবে জানলাম শিশুশিক্ষাকে আনন্দদায়ক ও ফলোদায়ক করার ক্ষেত্রে তাদের উল্লিখিত নতুন এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কে। সনাতনি মন্টেসরি স্কুলের (এ রকম স্কুলে শ্রেণীকক্ষ থাকে না এবং শিক্ষার্থীকে স্বাধীনতা দেয়া হয়) ধারণার সঙ্গে সেন্সর প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে তারা এই নয়া শিশুশিক্ষা ব্যবস্থার উদ্ভাবন করেছেন।
মিডিয়া ল্যাবের সোশ্যাল মেশিন রিসার্চ গ্রুপ বস্টনের নন-প্রফিট সংগঠন ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফাউন্ডেশনের সহায়তায় শিশুশিক্ষায় ‘সেনসেই’ প্রজেক্টের অধীনে সফলভাবে এ এক্সপেরিমেন্ট করে যাচ্ছে। জাপানি ভাষায় ‘সেনসেই’ শব্দের অর্থ হল শিক্ষক। কিন্তু তারা এর পূর্ণ নাম দিয়েছেন ‘সেন্সিং এডুকেশনাল ইন্টারেকশন’। এ শিশুশিক্ষা পদ্ধতিতে মনটেসরি স্কুলের মতো শ্রেণীকক্ষের ধারণা ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখানে সেন্সর প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে শিশুদের আগ্রহের এলাকা ও বিষয়বস্তু জানা হয়। আর একবার কোনো শিশুর আগ্রহ ও আনন্দের জায়গাটি চিহ্নিত করতে পারলে তাকে ওই বিষয়ে কাজ করিয়ে এগিয়ে নেয়ার কাজটি সহজ হয়ে যায়। শিশুর একাডেমিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষক-পর্যবেক্ষণ ও সামাজিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন- একটি শিশু যদি অঙ্ক না করতে চায়, তার ওপর অঙ্ক করার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয় না। সুকৌশলে অঙ্কে আগ্রহী অন্য সহপাঠীর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব করিয়ে দেয়া হয়। এ ব্যবস্থায় নিজের আনন্দ ও আগ্রহের জায়গায় কাজ করে শিশুরা তাদের স্কুলের সময় ও লেখাপড়া উপভোগ করতে পারে।
এ শিক্ষা পদ্ধতিতে কীভাবে শিশুর আগ্রহ জানা হয়- জানতে চাইলে নাজমুস সাকিব বলেন, আমাদের শিশুশিক্ষা পদ্ধতিতে ক্লাসরুম কনসেপ্ট নেই। একটি বড় ঘরে কতিপয় শিক্ষক শিশুদের শিক্ষা দেন। তাদের শিক্ষাদানকারী ভূমিকার চেয়ে শিশুদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের ভূমিকাই বেশি। এ পদ্ধতিতে শিশু স্কুলে এলে তার জুতা পরিবর্তন করে তাকে বিশেষভাবে তৈরি করা ছোট্ট মাইক্রোচিপযুক্ত সেন্সর লাগানো জুতা পরিয়ে শিক্ষাকক্ষে ছেড়ে দেয়া হয়। এ রকম সেন্সর শিক্ষাকক্ষের অন্যত্র এবং শিক্ষা উপকরণের ট্রেতেও ব্যবহার করা হয়। শিক্ষাকক্ষে শিশু সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাকে কোনো বিশেষ সময় বিশেষ বিষয়ে পড়তে বা শিখতে বলা হয় না। শিশু নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোনো শিক্ষক বা সহপাঠীর কাছে তার ইচ্ছামতো সময় কাটাতে পারে। সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকরা পরে কোন শিশুর কোন বিষয়ে কতটা আগ্রহ তা বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে তার অবস্থানের সময় নির্ণয় করে বুঝতে পারেন। ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ম্যাসাচুসেটসের বোস্টন শহরের ৬টি স্কুলে পরীক্ষামূলকভাবে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে শিশু শিক্ষাদান কার্যক্রম সফলভাবে চলমান রয়েছে।
এ নতুন শিশুশিক্ষা ব্যবস্থায় কেমন সাড়া পাচ্ছেন- এ প্রশ্নের উত্তরে সাকিব বলেন, প্রযুক্তিনির্ভর এ পদ্ধতিতে শিক্ষা দিতে গিয়ে শিক্ষকরা বেশ এক্সাইটেড। এতে করে শিক্ষকরাও অনেক কিছু শিখতে পারছেন। কেন কোনো শিশু তার কাছে বেশি সময় না দিয়ে অন্য একজন শিক্ষকের কাছে অধিক সময় দিচ্ছে, তা নিয়ে তারাও ভাবিত হচ্ছেন এবং এতে তাদের শিক্ষাদান পদ্ধতি উন্নত করতে নতুনভাবে চিন্তা করার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে এ পদ্ধতিতে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা কিছুটা ব্যয়বহুল। কিন্তু পদ্ধতিটি ফলোদায়ক হওয়ায় ইতিমধ্যে অভিভাবক এবং শিক্ষা গবেষকদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে। এ কারণে সেনসেই প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফাউন্ডেশনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। প্রযুক্তিনির্ভর এ নতুন শিক্ষাব্যবস্থা পাশ্চাত্য সমাজের জন্যও একটি নতুন শিশুশিক্ষা পদ্ধতি। তবে যেহেতু পদ্ধতিটি ইতিমধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ফলোদায়ক প্রমাণিত হয়েছে, সে কারণে আশা করা যায়, আগামী দিনের শিশুশিক্ষায় এ নতুন শিক্ষা পদ্ধতিটি ব্যয়বহুল হলেও একটি সমাদৃত শিশুশিক্ষা পদ্ধতি হিসেবে প্রথমে পাশ্চাত্যে এবং পরে ক্রমান্বয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রসারিত হবে।